অনন্য এক সত্তাঃ তাজউদ্দীন আহমদ

Posted: November 27, 2018 in Uncategorized

(২০ জুলাই, ২০১৭তে সাপ্তাহিক-এ প্রকাশিত)

একদা পরমমূল্য জন্মক্ষণ দিয়েছে তোমায়
আগন্তুক। রূপের দুর্লভ সত্তা লভিয়া বসেছ
সূর্যনক্ষত্রের সাথে। দূর আকাশের ছায়াপথে
যে আলোক আসে নামি’ ধরণীর শ্যামল ললাটে
সে তোমার চক্ষু চুম্বি’ তোমারে বেঁধেছে অনুক্ষণ
সখ্যডোরে দ্যুলোকের সাথে। দূর যুগান্তর হতে
মহাকাল-যাত্রী মহাবাণী পুণ্য মুহুর্তেরে তব
শুভক্ষণে দিয়েছে সম্মান; তোমার সম্মুখদিকে
আত্মার যাত্রার পন্থ গেছে চলি’ অনন্তের পানে
সেথা তুমি একা যাত্রী, অফুরন্ত এ মহাবিস্ময়।।

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (প্রান্তিক, ১৯৩৮)।

একবিংশ শতাব্দীর চলমান অস্থিরতার মাঝে ব্যক্তিপরিচয় যখন সংকটের সম্মুখীন, অস্তিত্বের সন্ধানে তখন চেনা পরিচিত নামগুলো, তাঁদের কাজ, তাঁদের চিন্তাগুলো খানিকটা হলেও স্বস্তি এনে দেয়। সেক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ’ ও ‘বাংলাদেশী’ বিশেষ্যের বাস্তবতা খুঁজে পেতে তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫) অন্যতম পথপ্রদর্শক।

‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী’ – এই ট্যাগলাইনের মাঝে তাঁর সার্বিক সত্তা আমাদের পাঠ্যসূচীতে আবদ্ধ। একজন রাষ্ট্রনায়কের জীবন ও সমাজ দর্শন, সেই সাথে তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের বিভিন্ন মাত্রার ওপর যতটা আলোকপাত হওয়া স্বাভাবিক, যতটা প্রাসঙ্গিক – তাজউদ্দীন আহমদ সেভাবে আলোচিত হননি সাধারণ পরিসরে।

তাঁর শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন কৃতিত্ব, জাতীয় মেধাতালিকায় অবস্থান, দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের একজন স্নাতক – এ যুগের যেকোনো শিক্ষার্থীর জন্যই তাঁর এ অর্জন অনুপ্রেরণামূলক। কিন্তু সেই সাথে তাঁর ব্যক্তিসত্তার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সমভাবে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। Reader’s Digestএর এক সংকলনে Bruce Bliven বলছেন, “… A person of average I.Q. who industriously stores up knowledge and skills year after year is better off than a person with a very high I.Q. who refuses to study. Studies indicate that some of the most important men in history had no more than ordinary I.Q.’s.

Among them, for example, are statesmen such as Cromwell, John Adams and Lincoln; military heroes like Drake, Napoleon and Nelson; writers like Goldsmith, Thackeray and Emerson. All these men, to be sure, were above the average in intelligence; yet they ranked far the most brilliant of the individuals studied. What they possessed in high degree was character, and the ability to keep plodding ahead until they achieved what they had set out to do…” (Your Brain’s Unrealized Powers, 1981).

সেক্ষেত্রে ‘তাজউদ্দীন আহমদ’ চরিত্র বিশ্লেষণে নৈর্ব্যক্তিক আলোচনার প্রধান উপাদান তাঁর নিজস্ব বক্তব্য এবং তাঁর সতীর্থ, সহকর্মী ও সমকালীন গুণীজনের অভিমত।

তাঁর দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কার্যক্রম, তাৎক্ষণিক চিন্তাভাবনা ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ডায়েরিতে লিপিবদ্ধের প্রয়াস থেকে তারুণ্যের স্বাভাবিক উদাসীনতার বদলে জীবনের প্রতি তাঁর একাগ্রতা ও নিষ্ঠার প্রমাণ মেলে।

দিনলিপির খুঁজে পাওয়া অংশগুলোতে তৎকালীন চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রতি তাঁর মনোযোগ দেখা যায়। যেমনঃ ২০ জুলাই ’৪৭, রবিবার তিনি লিখছেন, “গতকাল বার্মায় মন্ত্রিসভার বৈঠক চলাকালীন সময়ে জেনারেল অং সাং সহ ৫ মন্ত্রীকে সামরিক অভ্যুত্থানকারীরা গুলি করে হত্যা করেছে।” পরদিন অর্থাৎ ২১ জুলাই তিনি লিখছেন ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ আক্রমণের কথা। আবার ১৮ এপ্রিল ’৪৮, রবিবারে তাঁর ডায়েরি অনুযায়ী, “আজ সকাল ৬টা থেকে ইতালির পার্লামেন্টের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ৩৫৬টি দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ২টি দলই প্রধান। একটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গ্র্যাসপি (ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাট), অপরটির (পিপলস ফ্রন্ট) নেতৃত্ব দিচ্ছেন তোগলিয়াত (কমিউনিস্ট নেতা)। বিশ্বের সবার চোখ এখন ইতালির দিকে নিবদ্ধ। সে আমেরিকান ডলারতন্ত্র ও রুশ কমিউনিজমের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে। ফলাফল দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।” সুতরাং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের বিভিন্ন ঘটনা ও তার বিভিন্ন মাত্রা সম্পর্কে তরুণ তাজউদ্দীনের আগ্রহ ও জ্ঞানের গভীরতা এতেই লক্ষণীয়।

কিন্তু একইসাথে তিনি দেশীয় আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। ৩১ মার্চ ’৫০, শুক্রবার তিনি লিখছেন, “দেশে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার সূচনা হয়েছে। বিশেষ করে ভূমি মালিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণীর আয় হ্রাস পাওয়ায় তারা কিনতে পারছে না। বিদেশী সামগ্রী উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। চালের দাম কম। মণ প্রতি ১৫ থেকে ১৭ টাকার মধ্যে। এভাবেই মুদ্রামান অবমূল্যায়ন না করার ফায়দা পুরোপুরি তোলা হচ্ছে।” উল্লেখযোগ্যভাবে আবহাওয়া তাঁর আগ্রহের বিশাল জায়গা জুড়ে ছিল। প্রতিদিনের আনুমানিক তাপমাত্রা, বৃষ্টি হলে তার পরিমাণ, দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য ইত্যাদি তিনি প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করে লিপিবদ্ধ করেছেন ডায়েরিতে। মূলত স্থানীয় সার্বিক পরিস্থিতি যে তাঁর সার্বক্ষণিক অনুশীলনের অন্যতম বিষয় ছিল তা এতেই প্রতীয়মান।

সেই সাথে বিভিন্ন ঘটনা প্রসঙ্গে যুক্তির ভিত্তিতে তাঁর নিজস্ব একটি সুস্পষ্ট মতামত ডায়েরির বিভিন্ন অংশে পাওয়া যায়। যেমন তাঁর ৪ আগষ্ট ’৪৭, সোমবারের নথিভুক্তি অনুযায়ী, “বাংলার গণ-আন্দোলন কঠিন। কারণ সবাই কৃষক এবং তাঁরা কমবেশি জমির মালিক হতে চায়। কাজেই জমির জাতীয়করণ সহজ নয়। এক্ষেত্রে আরেকটি বড় বাধা হচ্ছে ইসলামী আইন।” একই পদ্ধতি তিনি অনুসরণ করেছেন বিভিন্ন চরিত্র অঙ্কনে। প্রসঙ্গ যাই হোক, প্রতিটি ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য আলোচনায় নিরপেক্ষতা রক্ষায় তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা উল্লেখযোগ্য। এবং নিজের বিভিন্ন কার্যক্রমের সার্বক্ষণিক যৌক্তিক মূল্যায়ন চালিয়েছেন তিনি, আত্মসমালোচনা, স্বীকারোক্তি অবলীলায় তুলে ধরেছেন নিজের লেখনীতে।

এছাড়া তাঁর স্বাভাবিক জীবন যাপনের প্রায় প্রতিটি অংশই টুকে রেখেছেন তিনি ডায়েরিতে। কারো সাথে কোথাও খাওয়া, কোথাও হটাৎ দেখা হওয়া, কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ করা – অর্থাৎ যে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সমগ্রতার অংশ হিসেবে সমান গুরুত্ব দেয়ার প্রবণতা দেখা যায় তাঁর মাঝে।

পরবর্তী সময়ে তাঁর সমসাময়িক ব্যক্তিবর্গ তাঁদের অভিজ্ঞতা ও মতামত জানিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদ প্রসঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আরহাম সিদ্দিকীর সাথে তাঁর পরিচয় শিক্ষাজীবনে। এক সাক্ষাৎকারে তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, “তিনি আমাদেরকে তাঁর মতের বিপক্ষে বলার জন্য আহ্বান জানাতেন। বলতেন, আমার বক্তব্যে একমত না হলে আপনাদের যা বলার আছে বলেন। যুক্তি দিয়ে যদি আমাকে বোঝাতে পারেন তা হলে মেনে নেব। আর যদি যুক্তিতর্কের পর বোঝা যায় আমার সিদ্ধান্তই ঠিক তাহলে যে পদ্ধতিতে আমি কাজটা করছি সেভাবেই আপনাদের মেনে নিতে হবে। তিনি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কথা বলতেন, যেটা আমাদের পক্ষে না মানা ছিল কঠিন। আমাদের চিন্তাধারাগুলোও প্রকাশ করার যথেষ্ট সুযোগ তিনি দিতেন।”

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ওয়াশিংটনে অবস্থানরত বাঙালি কূটনীতিক ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর ব্যাপারে বলেন, “একটা যুদ্ধ পরিচালনা করলেন একেবারে নিঃস্বার্থভাবে। আমার সামনে যত আলোচনা হল, কথাবার্তা হল, কোথাও ‘আমি’ শব্দটি নেই।”

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের দায়িত্বভারপ্রাপ্ত মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে তাজউদ্দীন আহমদের ব্যতিক্রমহীনভাবে তাঁর বিভিন্ন রণাঙ্গন পরিদর্শন, বিদেশী অতিথিদের সাথে তাঁর বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সাক্ষাৎ করা, বিগ্রেড ফোর্স গঠন সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার কথা উল্লেখ করেন।

শিক্ষাবিদ এবং যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে সম্পৃক্ত খান সারওয়ার মুরশিদ তাঁর মন্তব্যে জানান, “বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ নেতাদের মনে হত বেশি কথা বলেন, চেঁচামেচি করেন, স্লোগানের অতিরিক্ত তাঁরা ভাবেন বলে মনে হত না। কিন্তু এই ভদ্রলোক খুবই ভাবতেন এবং পৃথিবী সম্পর্কে অনেক বেশি ওয়াকেবহাল ছিলেন। তাঁর পৃথিবীটা শুধুই পূর্ব পাকিস্তান ছিল না, তাঁর পৃথিবীটা সত্যিই একটা বড় জায়গা ছিল।”

১৯৭১ সালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের আইজি গোলক মজুমদার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন তাজউদ্দীন-রুস্তমজী (’৭১য়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পরিচালক) কথোপকথন প্রসঙ্গে বলেন, “যে রুস্তমজীর চেষ্টায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ এবং যার সঙ্গে তাঁর এত মধুর সম্পর্ক, স্বদেশের স্বার্থে তাঁকেও স্পষ্ট ভাষায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে দৃঢ় মনোভাব জানাতে তাজউদ্দীন সাহেব মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করলেন না।”

এই বক্তব্যগুলোয় মূলত যুক্তিবাদী একটি মস্তিষ্ক, জাতীয়তাবাদী একটি চেতনা, চিন্তাশীল ও সহনশীল একটি মনের পরিচয় পাওয়া যায়। এবং তাজউদ্দীন আহমদের বিভিন্ন ভাষণ ও বিবৃতিতে এর অসংখ্য উদাহারণ দৃশ্যমান।

সার্বিকভাবে, নিজস্ব মতবাদের প্রতি আনুগত্যের পাশাপাশি প্রামাণ্য যুক্তির ভিত্তিতে সহিষ্ণুতা চর্চার মাধ্যমে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। সুতরাং ক্ষেত্র অনুপাতে তাঁর চরিত্র বিশ্লেষণে অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমের ভাষ্যই যথার্থ, “Tajuddin came much before his time and we are not yet ready to understand him properly.”

তথ্যসূত্রঃ

Bruce Bliven. (1981). Your Brain’s Unrealized Powers. Reader’s Digest: Mind Power. Hong Kong: Berkley.

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। (১৯৩৮)। প্রান্তিক। কলকাতাঃ বিশ্বভারতী।

সিমিন হোসেন রিমি। (_ _ _ _ -_ _ _ _)। তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি। ১ম – ৪র্থ খণ্ড। ঢাকাঃ প্রতিভাস প্রকাশনী।

সিমিন হোসেন রিমি। (২০১২)। তাজউদ্দীন আহমদঃ আলোকের অনন্তধারা। ১ম খণ্ড। ঢাকাঃ প্রতিভাস প্রকাশনী।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.