[২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮তে সাপ্তাহিক-এ প্রকাশিত]
‘স্থান-কাল-পাত্রভেদে …’ – বিশেষ এই উক্তিটির বিশ্লেষণী ভূমিকা অদ্ভুতভাবে শক্তিশালী, যেকোনো ঘটনার কার্যকারণের যুক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্য। ২০১৩য়ের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ‘১৫র বেসরকারি শিক্ষামাধ্যমে ভ্যাট নিরসন আর ‘১৮য়ে এসে কোটা সংস্কার আর নিরাপদ সড়কের দাবিতে গণসংযোগের যে ধরণ দেখা যায় বাংলাদেশের বাস্তব প্রেক্ষাপটে, চিরাচরিত আন্দোলনের ধারার সাথে এর পার্থক্য ধরা পড়ে খুব সহজেই – সাইবারস্পেস নামে এক ক্ষেত্রের ধারণা, যেখানে ঘটনার আদি-অন্তের ঠিকুজি অথবা স্থায়িত্ব নিরূপণ বেশ জটিল। তবে উপায় আছে।
সমসাময়িক সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের অবশ্য পাঠ্যতালিকায় ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের (২০০০) একটা বইয়ের নাম পাওয়া যায় – দ্য টিপিং পয়েন্ট; এখানে এর সামঞ্জস্য কোথায় তা বোঝা যাবে নামের পরবর্তী অংশেঃ হাউ লিটল থিংস ক্যান মেক আ বিগ ডিফারেন্স। প্রচ্ছদে একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি, বারুদের রাসায়নিক সূত্র আছে ভেতরের পাতায় – দ্য ল অব দ্য ফিউ, দ্য স্টিকিনেস ফ্যাক্টর, এবং দ্য পাওয়ার অব কনটেক্সট।
জনসাধারণের উপর কিছু অসাধারণের নিয়ন্ত্রণ আর তথ্যের চটকদারিতা কাদের দ্বারা আর কিভাবে উপরের ঘটনাগুলোয় উপস্থিত তা সহজবোধ্য। জটিলতার সূত্রপাত এর পটভূমিতে – কনটেক্সট – সাইবারস্পেস আর ফিজিক্যাল স্পেসের ব্যবধানের যা প্রধানতম নিয়ামক। মিশেল ফুকোর (১৯৮৪:৪৬) ভাষায়,
“আমরা আছি সমকালীনতার এক কালেঃ সামন্তরিক এক যুগে, দূর-অদূরের, সান্নিধ্য আর বিক্ষিপ্ততার এক কল্পে। আমার মতে, এ মুহুর্তে আমাদের সব জাগতিক অভিজ্ঞতা যতটা না সময়ের ধারায় জীবনের বিস্তৃতিকে ঘিরে, তার চাইতে বেশি বিন্দু আর বিভক্তিতে জট বাঁধা এক অন্তর্জালকে কেন্দ্র করে।”
তাহলে সাইবারস্পেস কি সাধারণ মতানুসারে শুধুই একটা মাধ্যম? নাকি এক স্বতন্ত্র জগৎ যেখানে সময় আর স্থানের অনুভূতি খানিকটা ভিন্ন? অ্যাজি বারাক আর জন স্যালার কিন্তু বলছেন, “যখন ওরা চালু করে ওদের কম্পিউটারগুলো, আরম্ভ করে কোনো প্রোগ্রাম, ই-মেইল লেখে বা কোনো ওয়েবসাইট ব্রাউজ করে, তারা চেতনে-অবচেতনে তাদের উপস্থিতিকে উপলব্ধি করে অর্থে-মর্মে-লক্ষ্যে-তাৎপর্যে বিস্তীর্ণ নতুন এক ‘ক্ষেত্রে’” (২০০৮:৩)।
সত্যি বলতে, সাইবারস্পেসের স্থানিক বৈশিষ্ট্য সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শিক্ষাজগতে বেশ আলোচিত হচ্ছে বিগত কয়েক বছর ধরেই। টবায়্যাস বুজ (২০১৭) ইতালির সিয়েনাতে বিরাজমান পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে সাইবারস্পেসের ওপর ফেনোমেনোলজিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গবেষণা চালান। অ্যরিজি আর গ্রাহাম (২০০৩) ইউরোপে ‘লোকাল সাইবারস্পেস’ গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে ‘ভার্চুয়াল নগরে’র ধারণা বিশ্লেষণ করেছেন তাঁদের লেখায়। জেনিফার লাইট (২০০৪) সাইবারস্পেসের বহুমাত্রিকতার ওপর আলোকপাত করেছেন, তুলনায় এনেছেন ব্যক্তি পর্যায়ে একটা শহরের মর্ম, এর অর্থ, এর তাৎপর্যকে। মার্টিন ডজ (১৯৯৯) তো আরও এক কাঠি ওপরে, তিনি তাঁর লেখায় ‘সাইবার জিওগ্রাফি’ নামে এক নতুন ধারার জন্য প্রচারণা চালিয়েছেন, পর্যালোচনা করেছেন বিশেষ দুটো মাত্রার ওপর – ইন্টারেনেটের পরিসংখ্যানিক ভূগোল আর সাইবারস্পেসের মানচিত্র গঠন। আর মাইকেল বেনেডিক্ট (১৯৯২) সাইবারস্পেসকে দেখছেন কার্ল পপারের (১৯৭৮) ‘তিন ভুবন’-এর তৃতীয় বিশ্বটি হিসেবে, যেখানে সবকিছুই চিন্তাপ্রসূত; শুনতে প্লেটোনিক মনে হলেও এর ভিত্তি ভৌত (প্রথম বিশ্ব) ও মানস (দ্বিতীয় বিশ্ব) জগতে। বেনেডিক্টের নিজের মতে, “সাইবারস্পেস, অন্তত যা দেখছি আমরা এখন, তৃতীয় বিশ্বে রূপান্তরিত হবার ঠিক সর্বশেষ পর্যায়টিতে আছে – বস্তুবাদের বোঝা হয়ে উঠছে প্রত্যাখ্যাত, পরিত্যক্ত – বারবার – এবং সম্ভবত চূড়ান্তবারের মতো” (১৯৯২:৪)।অর্থাৎ বিজ্ঞজনের মতানুযায়ী সাইবারস্পেস এমন এক ক্ষেত্র যেখানে প্রয়োজনীয় উপাদানের সামঞ্জস্যতার ভিত্তিতে একক কোনো ঘটনা সংঘটনের সম্ভাবনা রয়েছে, সুযোগ রয়েছে ভৌত জগতের কোনো বাস্তবতাকে প্রতিফলনেরও।
সুতরাং সাইবারস্পেসের কনটেক্সটে উল্লেখিত ঘটনাগুলোর ব্যাপকতা ও স্থায়িত্বের বিভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি আর ধারণার ভিন্নতার ভিত্তিতে, গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে বিশ্লেষণী শক্তির ওপর। তবে সাবলীলভাবে সাইবারস্পেসকে ‘যান্ত্রিক’, ‘অবাস্তব’, ‘কৃত্রিম’ বলে তাচ্ছিল্যের যে প্রবণতা রয়েছে সাধারণের মাঝে, পদ্ধতিগত বিশ্লেষণে ব্যাপারটা অতোটা নিরীহভাবে এগোবে না। কারণ,
“কোনো মতবাদ ধারণ-অনুধাবনের আগেই খারিজ করে দেয়া হলে তা পরিণত হয় এক বিপজ্জনক বিলাসিতায়”।
– মার্শাল ম্যাকলুহান (১৯৬২:২১৬)
তথ্যসূত্রঃ
Aurigi, A. & Graham, S. (2003). Cyberspace and the City: The “Virtual City” in Europe. In G. Bridge & S. Watson (Eds.), A Companion to the City. (pp. 489–502). Malden: Blackwell.
Barak, A. & Suler, J. (2008). Reflections on the Psychology and Social Science of Cyberspace. In Barak, A. (Eds.), Psychological Aspects of Cyberspace: Theory, Research, Applications. (pp. 1-12). New York: Cambridge University Press.
Benedikt, M. L. (1992). Cyberspace: First Steps. Cambridge: MIT Press.
Boos, T. (2017). Inhabiting Cyberspace and Emerging Cyberplaces: The Case of Siena, Italy. Cham: Palgrave Macmillan.
Dodge, M. (1999). The Geographies of Cyberspace. Centre for Advanced Spatial Analysis. University College London. Working Paper Series – 8.
Foucault, M. (1984). Of Other Spaces: Utopias and Heterotopias. Translated by Jay Miskowiec. Architecture, Mouvement, Continuité. 5. 46-49.
Gladwell, M. (2000). The Tipping Point: How Little Things Can Make a Big Difference. New York and Boston: Little Brown.
Light, J. S. (2004). From City Space to Cyberspace. In Crang, M., Crang, P. & May, J. (Eds.), Virtual Geographies: Bodies, Space and Relations. (pp. 109-130). New York: Routledge.
McLuhan, M. (1962). The Gutenberg Galaxy: The Making of Typographic Man. Quebec: University of Toronto Press.
Popper, K. (1978). Three Worlds. The Tanner Lecture on Human Values. University of Michigan.