Archive for November, 2018

[২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮তে সাপ্তাহিক-এ প্রকাশিত]

‘স্থান-কাল-পাত্রভেদে …’ – বিশেষ এই উক্তিটির বিশ্লেষণী ভূমিকা অদ্ভুতভাবে শক্তিশালী, যেকোনো ঘটনার কার্যকারণের যুক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্য। ২০১৩য়ের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ‘১৫র বেসরকারি শিক্ষামাধ্যমে ভ্যাট নিরসন আর ‘১৮য়ে এসে কোটা সংস্কার আর নিরাপদ সড়কের দাবিতে গণসংযোগের যে ধরণ দেখা যায় বাংলাদেশের বাস্তব প্রেক্ষাপটে, চিরাচরিত আন্দোলনের ধারার সাথে এর পার্থক্য ধরা পড়ে খুব সহজেই – সাইবারস্পেস নামে এক ক্ষেত্রের ধারণা, যেখানে ঘটনার আদি-অন্তের ঠিকুজি অথবা স্থায়িত্ব নিরূপণ বেশ জটিল। তবে উপায় আছে।

সমসাময়িক সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের অবশ্য পাঠ্যতালিকায় ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের (২০০০) একটা বইয়ের নাম পাওয়া যায় – দ্য টিপিং পয়েন্ট; এখানে এর সামঞ্জস্য কোথায় তা বোঝা যাবে নামের পরবর্তী অংশেঃ হাউ লিটল থিংস ক্যান মেক আ বিগ ডিফারেন্স। প্রচ্ছদে একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি, বারুদের রাসায়নিক সূত্র আছে ভেতরের পাতায় – দ্য ল অব দ্য ফিউ, দ্য স্টিকিনেস ফ্যাক্টর, এবং দ্য পাওয়ার অব কনটেক্সট।

জনসাধারণের উপর কিছু অসাধারণের নিয়ন্ত্রণ আর তথ্যের চটকদারিতা কাদের দ্বারা আর কিভাবে উপরের ঘটনাগুলোয় উপস্থিত তা সহজবোধ্য। জটিলতার সূত্রপাত এর পটভূমিতে – কনটেক্সট – সাইবারস্পেস আর ফিজিক্যাল স্পেসের ব্যবধানের যা প্রধানতম নিয়ামক। মিশেল ফুকোর (১৯৮৪:৪৬) ভাষায়,

“আমরা আছি সমকালীনতার এক কালেঃ সামন্তরিক এক যুগে, দূর-অদূরের, সান্নিধ্য আর বিক্ষিপ্ততার এক কল্পে। আমার মতে, এ মুহুর্তে আমাদের সব জাগতিক অভিজ্ঞতা যতটা না সময়ের ধারায় জীবনের বিস্তৃতিকে ঘিরে, তার চাইতে বেশি বিন্দু আর বিভক্তিতে জট বাঁধা এক অন্তর্জালকে কেন্দ্র করে।”

তাহলে সাইবারস্পেস কি সাধারণ মতানুসারে শুধুই একটা মাধ্যম? নাকি এক স্বতন্ত্র জগৎ যেখানে সময় আর স্থানের অনুভূতি খানিকটা ভিন্ন? অ্যাজি বারাক আর জন স্যালার কিন্তু বলছেন, “যখন ওরা চালু করে ওদের কম্পিউটারগুলো, আরম্ভ করে কোনো প্রোগ্রাম, ই-মেইল লেখে বা কোনো ওয়েবসাইট ব্রাউজ করে, তারা চেতনে-অবচেতনে তাদের উপস্থিতিকে উপলব্ধি করে অর্থে-মর্মে-লক্ষ্যে-তাৎপর্যে বিস্তীর্ণ নতুন এক ‘ক্ষেত্রে’” (২০০৮:৩)।

সত্যি বলতে, সাইবারস্পেসের স্থানিক বৈশিষ্ট্য সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শিক্ষাজগতে বেশ আলোচিত হচ্ছে বিগত কয়েক বছর ধরেই। টবায়্যাস বুজ (২০১৭) ইতালির সিয়েনাতে বিরাজমান পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে সাইবারস্পেসের ওপর ফেনোমেনোলজিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গবেষণা চালান। অ্যরিজি আর গ্রাহাম (২০০৩) ইউরোপে ‘লোকাল সাইবারস্পেস’ গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে ‘ভার্চুয়াল নগরে’র ধারণা বিশ্লেষণ করেছেন তাঁদের লেখায়। জেনিফার লাইট (২০০৪) সাইবারস্পেসের বহুমাত্রিকতার ওপর আলোকপাত করেছেন, তুলনায় এনেছেন ব্যক্তি পর্যায়ে একটা শহরের মর্ম, এর অর্থ, এর তাৎপর্যকে। মার্টিন ডজ (১৯৯৯) তো আরও এক কাঠি ওপরে, তিনি তাঁর লেখায় ‘সাইবার জিওগ্রাফি’ নামে এক নতুন ধারার জন্য প্রচারণা চালিয়েছেন, পর্যালোচনা করেছেন বিশেষ দুটো মাত্রার ওপর – ইন্টারেনেটের পরিসংখ্যানিক ভূগোল আর সাইবারস্পেসের মানচিত্র গঠন। আর মাইকেল বেনেডিক্ট (১৯৯২) সাইবারস্পেসকে দেখছেন কার্ল পপারের (১৯৭৮) ‘তিন ভুবন’-এর তৃতীয় বিশ্বটি হিসেবে, যেখানে সবকিছুই চিন্তাপ্রসূত; শুনতে প্লেটোনিক মনে হলেও এর ভিত্তি ভৌত (প্রথম বিশ্ব) ও মানস (দ্বিতীয় বিশ্ব) জগতে। বেনেডিক্টের নিজের মতে, “সাইবারস্পেস, অন্তত যা দেখছি আমরা এখন, তৃতীয় বিশ্বে রূপান্তরিত হবার ঠিক সর্বশেষ পর্যায়টিতে আছে – বস্তুবাদের বোঝা হয়ে উঠছে প্রত্যাখ্যাত, পরিত্যক্ত – বারবার – এবং সম্ভবত চূড়ান্তবারের মতো” (১৯৯২:৪)।অর্থাৎ বিজ্ঞজনের মতানুযায়ী সাইবারস্পেস এমন এক ক্ষেত্র যেখানে প্রয়োজনীয় উপাদানের সামঞ্জস্যতার ভিত্তিতে একক কোনো ঘটনা সংঘটনের সম্ভাবনা রয়েছে, সুযোগ রয়েছে ভৌত জগতের কোনো বাস্তবতাকে প্রতিফলনেরও।

সুতরাং সাইবারস্পেসের কনটেক্সটে উল্লেখিত ঘটনাগুলোর ব্যাপকতা ও স্থায়িত্বের বিভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি আর ধারণার ভিন্নতার ভিত্তিতে, গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে বিশ্লেষণী শক্তির ওপর। তবে সাবলীলভাবে সাইবারস্পেসকে ‘যান্ত্রিক’, ‘অবাস্তব’, ‘কৃত্রিম’ বলে তাচ্ছিল্যের যে প্রবণতা রয়েছে সাধারণের মাঝে, পদ্ধতিগত বিশ্লেষণে ব্যাপারটা অতোটা নিরীহভাবে এগোবে না। কারণ,

“কোনো মতবাদ ধারণ-অনুধাবনের আগেই খারিজ করে দেয়া হলে তা পরিণত হয় এক বিপজ্জনক বিলাসিতায়”।
– মার্শাল ম্যাকলুহান (১৯৬২:২১৬)

তথ্যসূত্রঃ

Aurigi, A. & Graham, S. (2003). Cyberspace and the City: The “Virtual City” in Europe. In G. Bridge & S. Watson (Eds.), A Companion to the City. (pp. 489–502). Malden: Blackwell.

Barak, A. & Suler, J. (2008). Reflections on the Psychology and Social Science of Cyberspace. In Barak, A. (Eds.), Psychological Aspects of Cyberspace: Theory, Research, Applications. (pp. 1-12). New York: Cambridge University Press.

Benedikt, M. L. (1992). Cyberspace: First Steps. Cambridge: MIT Press.

Boos, T. (2017). Inhabiting Cyberspace and Emerging Cyberplaces: The Case of Siena, Italy. Cham: Palgrave Macmillan.

Dodge, M. (1999). The Geographies of Cyberspace. Centre for Advanced Spatial Analysis. University College London. Working Paper Series – 8.

Foucault, M. (1984). Of Other Spaces: Utopias and Heterotopias. Translated by Jay Miskowiec. Architecture, Mouvement, Continuité. 5. 46-49.

Gladwell, M. (2000). The Tipping Point: How Little Things Can Make a Big Difference. New York and Boston: Little Brown.

Light, J. S. (2004). From City Space to Cyberspace. In Crang, M., Crang, P. & May, J. (Eds.), Virtual Geographies: Bodies, Space and Relations. (pp. 109-130). New York: Routledge.

McLuhan, M. (1962). The Gutenberg Galaxy: The Making of Typographic Man. Quebec: University of Toronto Press.

Popper, K. (1978). Three Worlds. The Tanner Lecture on Human Values. University of Michigan.

(২০ জুলাই, ২০১৭তে সাপ্তাহিক-এ প্রকাশিত)

একদা পরমমূল্য জন্মক্ষণ দিয়েছে তোমায়
আগন্তুক। রূপের দুর্লভ সত্তা লভিয়া বসেছ
সূর্যনক্ষত্রের সাথে। দূর আকাশের ছায়াপথে
যে আলোক আসে নামি’ ধরণীর শ্যামল ললাটে
সে তোমার চক্ষু চুম্বি’ তোমারে বেঁধেছে অনুক্ষণ
সখ্যডোরে দ্যুলোকের সাথে। দূর যুগান্তর হতে
মহাকাল-যাত্রী মহাবাণী পুণ্য মুহুর্তেরে তব
শুভক্ষণে দিয়েছে সম্মান; তোমার সম্মুখদিকে
আত্মার যাত্রার পন্থ গেছে চলি’ অনন্তের পানে
সেথা তুমি একা যাত্রী, অফুরন্ত এ মহাবিস্ময়।।

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (প্রান্তিক, ১৯৩৮)।

একবিংশ শতাব্দীর চলমান অস্থিরতার মাঝে ব্যক্তিপরিচয় যখন সংকটের সম্মুখীন, অস্তিত্বের সন্ধানে তখন চেনা পরিচিত নামগুলো, তাঁদের কাজ, তাঁদের চিন্তাগুলো খানিকটা হলেও স্বস্তি এনে দেয়। সেক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ’ ও ‘বাংলাদেশী’ বিশেষ্যের বাস্তবতা খুঁজে পেতে তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫) অন্যতম পথপ্রদর্শক।

‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী’ – এই ট্যাগলাইনের মাঝে তাঁর সার্বিক সত্তা আমাদের পাঠ্যসূচীতে আবদ্ধ। একজন রাষ্ট্রনায়কের জীবন ও সমাজ দর্শন, সেই সাথে তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের বিভিন্ন মাত্রার ওপর যতটা আলোকপাত হওয়া স্বাভাবিক, যতটা প্রাসঙ্গিক – তাজউদ্দীন আহমদ সেভাবে আলোচিত হননি সাধারণ পরিসরে।

তাঁর শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন কৃতিত্ব, জাতীয় মেধাতালিকায় অবস্থান, দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের একজন স্নাতক – এ যুগের যেকোনো শিক্ষার্থীর জন্যই তাঁর এ অর্জন অনুপ্রেরণামূলক। কিন্তু সেই সাথে তাঁর ব্যক্তিসত্তার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সমভাবে আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। Reader’s Digestএর এক সংকলনে Bruce Bliven বলছেন, “… A person of average I.Q. who industriously stores up knowledge and skills year after year is better off than a person with a very high I.Q. who refuses to study. Studies indicate that some of the most important men in history had no more than ordinary I.Q.’s.

Among them, for example, are statesmen such as Cromwell, John Adams and Lincoln; military heroes like Drake, Napoleon and Nelson; writers like Goldsmith, Thackeray and Emerson. All these men, to be sure, were above the average in intelligence; yet they ranked far the most brilliant of the individuals studied. What they possessed in high degree was character, and the ability to keep plodding ahead until they achieved what they had set out to do…” (Your Brain’s Unrealized Powers, 1981).

সেক্ষেত্রে ‘তাজউদ্দীন আহমদ’ চরিত্র বিশ্লেষণে নৈর্ব্যক্তিক আলোচনার প্রধান উপাদান তাঁর নিজস্ব বক্তব্য এবং তাঁর সতীর্থ, সহকর্মী ও সমকালীন গুণীজনের অভিমত।

তাঁর দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কার্যক্রম, তাৎক্ষণিক চিন্তাভাবনা ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ডায়েরিতে লিপিবদ্ধের প্রয়াস থেকে তারুণ্যের স্বাভাবিক উদাসীনতার বদলে জীবনের প্রতি তাঁর একাগ্রতা ও নিষ্ঠার প্রমাণ মেলে।

দিনলিপির খুঁজে পাওয়া অংশগুলোতে তৎকালীন চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রতি তাঁর মনোযোগ দেখা যায়। যেমনঃ ২০ জুলাই ’৪৭, রবিবার তিনি লিখছেন, “গতকাল বার্মায় মন্ত্রিসভার বৈঠক চলাকালীন সময়ে জেনারেল অং সাং সহ ৫ মন্ত্রীকে সামরিক অভ্যুত্থানকারীরা গুলি করে হত্যা করেছে।” পরদিন অর্থাৎ ২১ জুলাই তিনি লিখছেন ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ আক্রমণের কথা। আবার ১৮ এপ্রিল ’৪৮, রবিবারে তাঁর ডায়েরি অনুযায়ী, “আজ সকাল ৬টা থেকে ইতালির পার্লামেন্টের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ৩৫৬টি দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ২টি দলই প্রধান। একটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গ্র্যাসপি (ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাট), অপরটির (পিপলস ফ্রন্ট) নেতৃত্ব দিচ্ছেন তোগলিয়াত (কমিউনিস্ট নেতা)। বিশ্বের সবার চোখ এখন ইতালির দিকে নিবদ্ধ। সে আমেরিকান ডলারতন্ত্র ও রুশ কমিউনিজমের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে। ফলাফল দেখতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।” সুতরাং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের বিভিন্ন ঘটনা ও তার বিভিন্ন মাত্রা সম্পর্কে তরুণ তাজউদ্দীনের আগ্রহ ও জ্ঞানের গভীরতা এতেই লক্ষণীয়।

কিন্তু একইসাথে তিনি দেশীয় আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। ৩১ মার্চ ’৫০, শুক্রবার তিনি লিখছেন, “দেশে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার সূচনা হয়েছে। বিশেষ করে ভূমি মালিক মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণীর আয় হ্রাস পাওয়ায় তারা কিনতে পারছে না। বিদেশী সামগ্রী উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। চালের দাম কম। মণ প্রতি ১৫ থেকে ১৭ টাকার মধ্যে। এভাবেই মুদ্রামান অবমূল্যায়ন না করার ফায়দা পুরোপুরি তোলা হচ্ছে।” উল্লেখযোগ্যভাবে আবহাওয়া তাঁর আগ্রহের বিশাল জায়গা জুড়ে ছিল। প্রতিদিনের আনুমানিক তাপমাত্রা, বৃষ্টি হলে তার পরিমাণ, দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য ইত্যাদি তিনি প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করে লিপিবদ্ধ করেছেন ডায়েরিতে। মূলত স্থানীয় সার্বিক পরিস্থিতি যে তাঁর সার্বক্ষণিক অনুশীলনের অন্যতম বিষয় ছিল তা এতেই প্রতীয়মান।

সেই সাথে বিভিন্ন ঘটনা প্রসঙ্গে যুক্তির ভিত্তিতে তাঁর নিজস্ব একটি সুস্পষ্ট মতামত ডায়েরির বিভিন্ন অংশে পাওয়া যায়। যেমন তাঁর ৪ আগষ্ট ’৪৭, সোমবারের নথিভুক্তি অনুযায়ী, “বাংলার গণ-আন্দোলন কঠিন। কারণ সবাই কৃষক এবং তাঁরা কমবেশি জমির মালিক হতে চায়। কাজেই জমির জাতীয়করণ সহজ নয়। এক্ষেত্রে আরেকটি বড় বাধা হচ্ছে ইসলামী আইন।” একই পদ্ধতি তিনি অনুসরণ করেছেন বিভিন্ন চরিত্র অঙ্কনে। প্রসঙ্গ যাই হোক, প্রতিটি ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য আলোচনায় নিরপেক্ষতা রক্ষায় তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা উল্লেখযোগ্য। এবং নিজের বিভিন্ন কার্যক্রমের সার্বক্ষণিক যৌক্তিক মূল্যায়ন চালিয়েছেন তিনি, আত্মসমালোচনা, স্বীকারোক্তি অবলীলায় তুলে ধরেছেন নিজের লেখনীতে।

এছাড়া তাঁর স্বাভাবিক জীবন যাপনের প্রায় প্রতিটি অংশই টুকে রেখেছেন তিনি ডায়েরিতে। কারো সাথে কোথাও খাওয়া, কোথাও হটাৎ দেখা হওয়া, কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ করা – অর্থাৎ যে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সমগ্রতার অংশ হিসেবে সমান গুরুত্ব দেয়ার প্রবণতা দেখা যায় তাঁর মাঝে।

পরবর্তী সময়ে তাঁর সমসাময়িক ব্যক্তিবর্গ তাঁদের অভিজ্ঞতা ও মতামত জানিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদ প্রসঙ্গে।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আরহাম সিদ্দিকীর সাথে তাঁর পরিচয় শিক্ষাজীবনে। এক সাক্ষাৎকারে তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, “তিনি আমাদেরকে তাঁর মতের বিপক্ষে বলার জন্য আহ্বান জানাতেন। বলতেন, আমার বক্তব্যে একমত না হলে আপনাদের যা বলার আছে বলেন। যুক্তি দিয়ে যদি আমাকে বোঝাতে পারেন তা হলে মেনে নেব। আর যদি যুক্তিতর্কের পর বোঝা যায় আমার সিদ্ধান্তই ঠিক তাহলে যে পদ্ধতিতে আমি কাজটা করছি সেভাবেই আপনাদের মেনে নিতে হবে। তিনি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কথা বলতেন, যেটা আমাদের পক্ষে না মানা ছিল কঠিন। আমাদের চিন্তাধারাগুলোও প্রকাশ করার যথেষ্ট সুযোগ তিনি দিতেন।”

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ওয়াশিংটনে অবস্থানরত বাঙালি কূটনীতিক ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর ব্যাপারে বলেন, “একটা যুদ্ধ পরিচালনা করলেন একেবারে নিঃস্বার্থভাবে। আমার সামনে যত আলোচনা হল, কথাবার্তা হল, কোথাও ‘আমি’ শব্দটি নেই।”

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের দায়িত্বভারপ্রাপ্ত মেজর আবু ওসমান চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে তাজউদ্দীন আহমদের ব্যতিক্রমহীনভাবে তাঁর বিভিন্ন রণাঙ্গন পরিদর্শন, বিদেশী অতিথিদের সাথে তাঁর বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সাক্ষাৎ করা, বিগ্রেড ফোর্স গঠন সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার কথা উল্লেখ করেন।

শিক্ষাবিদ এবং যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে সম্পৃক্ত খান সারওয়ার মুরশিদ তাঁর মন্তব্যে জানান, “বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ নেতাদের মনে হত বেশি কথা বলেন, চেঁচামেচি করেন, স্লোগানের অতিরিক্ত তাঁরা ভাবেন বলে মনে হত না। কিন্তু এই ভদ্রলোক খুবই ভাবতেন এবং পৃথিবী সম্পর্কে অনেক বেশি ওয়াকেবহাল ছিলেন। তাঁর পৃথিবীটা শুধুই পূর্ব পাকিস্তান ছিল না, তাঁর পৃথিবীটা সত্যিই একটা বড় জায়গা ছিল।”

১৯৭১ সালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের আইজি গোলক মজুমদার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন তাজউদ্দীন-রুস্তমজী (’৭১য়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পরিচালক) কথোপকথন প্রসঙ্গে বলেন, “যে রুস্তমজীর চেষ্টায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ এবং যার সঙ্গে তাঁর এত মধুর সম্পর্ক, স্বদেশের স্বার্থে তাঁকেও স্পষ্ট ভাষায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে দৃঢ় মনোভাব জানাতে তাজউদ্দীন সাহেব মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করলেন না।”

এই বক্তব্যগুলোয় মূলত যুক্তিবাদী একটি মস্তিষ্ক, জাতীয়তাবাদী একটি চেতনা, চিন্তাশীল ও সহনশীল একটি মনের পরিচয় পাওয়া যায়। এবং তাজউদ্দীন আহমদের বিভিন্ন ভাষণ ও বিবৃতিতে এর অসংখ্য উদাহারণ দৃশ্যমান।

সার্বিকভাবে, নিজস্ব মতবাদের প্রতি আনুগত্যের পাশাপাশি প্রামাণ্য যুক্তির ভিত্তিতে সহিষ্ণুতা চর্চার মাধ্যমে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। সুতরাং ক্ষেত্র অনুপাতে তাঁর চরিত্র বিশ্লেষণে অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমের ভাষ্যই যথার্থ, “Tajuddin came much before his time and we are not yet ready to understand him properly.”

তথ্যসূত্রঃ

Bruce Bliven. (1981). Your Brain’s Unrealized Powers. Reader’s Digest: Mind Power. Hong Kong: Berkley.

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। (১৯৩৮)। প্রান্তিক। কলকাতাঃ বিশ্বভারতী।

সিমিন হোসেন রিমি। (_ _ _ _ -_ _ _ _)। তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি। ১ম – ৪র্থ খণ্ড। ঢাকাঃ প্রতিভাস প্রকাশনী।

সিমিন হোসেন রিমি। (২০১২)। তাজউদ্দীন আহমদঃ আলোকের অনন্তধারা। ১ম খণ্ড। ঢাকাঃ প্রতিভাস প্রকাশনী।