মিসেস ম্যালার্ড হৃদরোগে আক্রান্ত, তাই যতটা সম্ভব সাবধানতার সাথে, যথেষ্ট ধীরস্থিরভাবে তাঁকে জানানো হল খবরটা; তাঁর স্বামীর মৃত্যু সংবাদ।
ঘটনার প্রায় অর্ধেকই গোপন রেখে, ভাঙা ভাঙা বাক্যে, প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে, তাঁর বোন জোসেফিন জানালেন তাঁকে ব্যাপারটা। তাঁর স্বামীর বন্ধু রিচার্ডসও আছেন সেখানে, তাঁর কাছে। তিনিই পত্রিকা অফিসে ছিলেন যখন রেলওয়ে দূর্যোগের খবরটা পাওয়া যায়, সেই সাথে ব্রেন্টলি ম্যালার্ডের নামসহ একটা তালিকাও; “নিহত”দের তালিকা। তিনি নিশ্চিত হওয়ার জন্য দ্বিতীয় টেলিগ্রামটা পাওয়া অব্দি অপেক্ষা করেন, আর এরপরেই তাড়াহুড়ো করে ছুটে আসেন জানাতে; যাতে কোনো উদাসীন, কোনো অসাবধানী বন্ধুর কাছ থেকে খারাপ খবরটা শুনতে না হয় তাঁকে।
অন্যান্য নারীরা যেভাবে গ্রহণ করেন এধরণের সংবাদকে, ঘটনার মর্মার্থকে মেনে নেয়ার যে অক্ষমতা দেখা যায় তাঁদের মধ্যে; মিসেস ম্যালার্ডের ক্ষেত্রে তেমন কিছু হল না। বোনকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলেন একবার, হটাৎ করেই; এরপর শোকের তীব্রতা কেটে গেল আপনাআপনিই, উঠে চলে গেলেন নিজের রুমে, একাই। অনুসরন করতে দিলেন না কাউকে।
একটা আরামকেদারা রাখা সেখানে, জানালামুখী; একটা প্রশস্ত, স্বস্তিময় আরামকেদারা। ঢলে পড়লেন তাতে, শরীরটাকে চাপিয়ে দিলেন চেয়ারটায়; দেহটা নুইয়ে পড়েছে শারীরিক অবসাদে, চেষ্টায় আছে মনটাকেও গ্রাস করার।
নিজের বাড়ির সামনের খোলা উঠোন, বসন্তের বাতাসে উদ্বেলিত গাছপালা; সবই দেখছিলেন তিনি। বৃষ্টির ভেজা গন্ধ ভাসছিল চারদিকে। নিচে রাস্তায় বেসাতি নিয়ে চিৎকার করে চলেছে এক ফেরিওয়ালা। দূরে কোথাও গাইতে থাকা কারো গান ক্ষীণভাবে ভেসে আসছিল তাঁর কানে, ঘরের ছাঁইচে কিচিরমিচির করছিল অসংখ্য চড়ুই।
পেঁজা তুলোর মতো মেঘের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছিল নীল আকাশটা; সেসবই দেখছিলেন তাঁর পশ্চিমমুখী জানালা দিয়ে।
চেয়ারের কুশনের উপর মাথা রেখে বসেছিলেন তিনি, বেশ নিস্পন্দভাবে; যতক্ষণ না কান্নার এক দমক এসে ধাক্কা দিল তাঁর গলায়।
২
সুন্দর, শান্ত এক মুখশ্রীর অধিকারী ছিলেন তিনি তারুণ্যে; যেটাতে ফরমায়েশী দমনের তেজ প্রকাশ পেত, একই সাথে দৃঢ় শক্তিরও। কিন্তু এখন; তাঁর চোখে এখন ফিকে দৃষ্টি, আটকে আছে ঐ অদূরের এক চিলতে নীল আকাশে। এই চাহনিতে কোনো বিচক্ষণতার রেশ ছিল না, বরং বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তাশক্তির স্থগিতাদেশের লক্ষণই ফুটে উঠেছিল সেখানে।
আগমনী বার্তা পাচ্ছিলেন তিনি কিছু একটার, তাঁর কাছে আসছে। তিনিও অপেক্ষা করে আছেন সেটির জন্য, ভীত-সন্ত্রস্ত্রভাবে। কি সেটা? জানেন না তিনি; দূর্বোধ্য, অধরা, অস্পৃশ্যকে সংজ্ঞায়ন করবেনই বা কী করে! কিন্তু অনুভব করতে পারছিলেন, আশেপাশের রং-বর্ণ-গন্ধ সবকিছু ছাপিয়ে শূন্য থেকে ধেয়ে আসছে সেটি তাঁর দিকে, ধীরে ধীরে।
বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলেন তিনি হটাৎ; চিনতে পেরেছেন, কে তাঁকে আচ্ছন্ন করতে চাইছে। সমস্ত শক্তি দিয়ে বিরোধিতা করতে থাকলেন তিনি, ফিরিয়ে দিতে চাইছেন তাকে, অবশ্য সেই শক্তির জোর তাঁর দুই রোগা, শুকনো হাতের মতোই ক্ষমতাশীল।
হাল ছেড়ে দিলেন এক সময়, চাপাস্বরে কিছু শব্দ বেড়িয়ে এলো তাঁর মুখ থেকে; বারবারঃ “মুক্তি, মুক্তি, মুক্তি!” তাঁর চোখের ফাঁকা দৃষ্টিতে ভয়ের আভাস; ব্যগ্র, উজ্জ্বল হয়ে উঠল তা। নাড়ী-স্পন্দন বেড়ে গেল তাঁর, বহমান রক্তকণিকা উষ্ণতর হয়ে উঠল, নিরুত্তেজ হয়ে পড়ল শরীরের প্রতিটি অংশ।
তিনি জানতেন, আবার কান্নায় ভেঙে পড়বেন তিনি, যখন সেই অমায়িক, স্নেহময় হাতদুটোকে দেখবেন মৃত্যুর মোড়কে ঢাকা; সেই মুখখানা, যাতে তাঁর জন্য ফুটে উঠত শুধুই মমতা, ভালবাসা; স্থির, ধূসর এবং, মৃত হয়ে দেখা দেবে তাঁর কাছে আজ। কিন্তু এই দুঃসহ সন্ধিক্ষণের আগে তো তিনি একটা দীর্ঘ সময় পার করে এসেছেন; সেইসব মুহুর্ত শুধুই তাঁর, একান্ত নিজের। হাতছানি দিয়ে সেসবকেই স্বাগত জানাচ্ছেন এখন স্মৃতির পাতায়।
সামনের দিনগুলোতে অন্য কারো জন্য টিকে থাকতে হবে না তাঁকে, এখন থেকে নিজের জন্যই বেঁচে থাকবেন তিনি। কোনো বন্ধনে আবদ্ধ নন তিনি এখন, নেই কোনো অদৃশ্য স্বত্বার অস্তিত্ব, যার বদৌলতে নর-নারীর অধিকার থাকে একে-অন্যের উপর নিজস্ব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার। উদ্দেশ্য মহৎ হোক বা রুক্ষ; এই মুহুর্তে এমন চিন্তা-ধারণা প্রশ্রয় দেয়াকে রীতিমত কোনো পাপের পর্যায়েই পড়ে।
৩
তিনি কিন্তু ভালবাসতেন তাঁর স্বামীকে— কখনো। আবার কখনো নয়। কী আসে যায় তাতে! ভালবাসা, বরাবরই যা এক অমীমাংসিত রহস্য; নিজের সবকিছুর ওপর এর দখলদারিকেই হটাৎ তাঁর কাছে মনে হচ্ছে তাঁর অস্তিত্বের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত!
“মুক্তি! দেহের, আত্মার মুক্তি!” মৃদু স্বরে বলতে থাকলেন তিনি।
জোসেফিন দরজার সামনে হাঁটুগেড়ে বসে কী-হোলে মুখ রেখে বলতে থাকলেনঃ “লুইস, দরজাটা খোল দয়া করে। অসুস্থ বানাবে তো নিজেকে। কি করছ তুমি লুইস? ঈশ্বরের দোহাই দরজাটা খোল।”
“যাও তুমি, অসুস্থ হব না আমি।” জীবনের রূপ-রস পানে ডুবে আছেন তখন তিনি, খোলা জানালা দিয়ে।
খেয়ালী কল্পনাগুলো ছুটে বেড়াতে লাগল তাঁর স্মৃতিতে। বসন্ত, গ্রীস্মের দিনগুলো; যে মুহুর্তগুলো তাঁর একান্ত আপন। প্রার্থনা করলেন তিনি দীর্ঘায়ু জীবনের জন্য, অথচ গতকালও শিহরিত হতেন জীবনের স্থায়িত্বের ব্যাপারে ভেবে।
উঠে দাঁড়ালেন তিনি অবশেষে, বোনের জোরাজুরিতে দরজা খুললেন। তাঁর চোখে তখন জয়ের উত্তেজনা খেলা করছে, সাফল্যের দেবীকে যেন ধারণ করেছেন তাঁর শরীরে। বোনের বাহু আঁকড়ে ধরে নিচে নামতে থাকলেন তিনি, সিঁড়ির শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে রিচার্ডস।
সামনের দরজা খুলছেন কেউ একজন। আর কেউ নন, তিনি ব্রেন্টলি ম্যালার্ড; ভ্রমণের ক্লান্তি আর হাত-ব্যাগ ও ছাতা সাথে নিয়ে ঢুকলেন বাড়িতে। দূর্ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূরে ছিলেন তিনি, এমনকি জানতেনও না যে এরকম কিছু একটা ঘটেছে। অবাক হয়ে জোসেফিনের বাঁধভাঙা কান্না দেখছেন তিনি, আর তাঁকে আড়াল করার জন্য রিচার্ডস দ্রুত সরে গেলেন, যাতে হটাৎ তাঁর স্ত্রীর নজরে তিনি না পড়েন।
কিন্তু বেশ দেরী করে ফেলেছেন রিচার্ডস।
ডাক্তাররা বললেন যে, তিনি মারা গেছেন হৃদরোগেই– উচ্ছাসের তাড়নায় মৃত্যু ঘটেছে তাঁর।