Archive for March, 2015

“বল্‌ তো, বাংলা কবিতায় হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট খায় না মাথায় দেয়?” – বাইশে শ্রাবণ চলচ্চিত্রটিতে প্রবীর রায় চৌধুরীর এমন প্রশ্নের উত্তর Wikipedia তে দেয়া আছে এভাবে, “বাংলা সাহিত্যে স্থিতাবস্থা ভাঙার আওয়াজ তুলে, ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে, শিল্প ও সাহিত্যের যে একমাত্র আন্দোলন হয়েছে, তার নাম হাংরি আন্দোলন”। নিবারণ চক্রবর্তীর মতো কবিদের আর্তি, কাতরতা…… সঠিকভাবে অন্য শব্দ তুলে ধরতে পারবে না বলে, আন্দোলনকারীরা শেষাবধি এই হাংরি(Hungry) শব্দটি গ্রহণ করেন।

এই আন্দোলনের মূল ভাবনার সূত্রপাত মাত্র ২১ বছর বয়সী মলয় রায়চৌধুরী নামে এক তরুণের মস্তিষ্কে। দিগঙ্গন পত্রিকায় ২০০৪ সালে প্রকাশিত প্রতিসন্দর্ভের স্মৃতি প্রবন্ধে কবি মলয় রায় চৌধুরীর বর্ণানুসারে, “স্বদেশী আন্দোলনের সময় জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা টকে গিয়ে পচতে শুরু করেছে উত্তর ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে”। ওসওয়াল্ড স্পেংলার এর লেখা “The Decline of the West” বইটির মূল বক্তব্য থেকে তিনি এই আন্দোলনের দর্শন গড়ে তুলেছিলেন। স্পেংলারের মতে “কোনো সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরল রেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় ; তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার উপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে | কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন”। মলয়ের এই ধারণা হয়েছিল যে দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালীর আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। সুতরাং কিঞ্চিদধিক হলেও, এমনকি যদি ডিরোজিওর পর্যায়েও না হয়, তবু হস্তক্ষেপ দরকার, আওয়াজ তোলা দরকার, আন্দোলন প্রয়োজন।

১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা থেকে প্রথম ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের বহিঃপ্রকাশ ঘটে মলয়, তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধারা ওরফে দেবী রায় এর হাত ধরে। কবিতা সম্পর্কিত সেই ইশতেহারটি ছিল ইংরেজিতে, কারণ পাটনায় বাংলা প্রেস পাওয়া যায় নি।

হাংরি আন্দোলনের উদ্দেশ্য সংবলিত প্রথম ইশতিহার মলয় রায় চৌধুরীর লেখনি থেকে সরাসরি তুলে দেয়া হল—
১. অ্যারিস্টটলের বাস্তবতাকে কখনও নকল করা হবে না, কিন্ত বলাতপ্রস্তুতির মাধ্যমে আচমকা জাপটে ধরতে হবে অপ্রস্তুত ছেনালি অস্তি।
২. নৈঃশব্দকে অটুট রেখে নির্বাককে বাস্তব হয়ে উঠতে হবে।
৩. ঠিক সেই রকম সৃষ্টি-উন্মার্গে চালিত হতে হবে যাতে আগে থাকতে তৈরি পৃথিবীকে চুরমার করে পুনর্বার বিশৃঙ্খলা থেকে শুরু করা যায়।
৪. লেখকের চেতনাকে বর্জন করে প্রতিটি অন্য বোধ-জরায়ুকে কাজে লাগানো হবে।
৫. ফাঁস করে দেয়া হবে যে, কেবল কান্তি- সত্তা হিসাবেই জীবন ও অস্তিত্ব স্বীকৃত।
৬. অন্যের প্রদত্ত বোধ- জ্ঞানের চেয়ে বরং সমস্তরকম সন্দেহ ও অসহায়তাকে গ্রহণ করা হবে।
৭. দ্বিপদ-উন্নতিকামী প্রাণীদের তাবৎ মূল্যবোধকে আক্রমণ করে ছারখার করা হবে।
৮. চরম সততার উদ্দেশ্যে সবরকম চাটুকারদের মাগিদের শপৎপূর্বক পরিত্যাগ করা হবে।
৯. আত্মাবিষ্কারের পর লেখা আর আঁকা ছেড়ে দেয়া হবে।

পঞ্চাশের দশকে ইউরোপে সংঘটিত তৎকালীন সময়কেন্দ্রিক কিছু শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনের আদলে বাংলা সাহিত্যেও এক বিপ্লবের চেষ্টা চলছিল যার মূলে ছিল কৃত্তিবাস গোষ্ঠী। অনেকে এই সাহিত্য গোষ্ঠীর সাথে হাংরি আন্দোলনকে মিলিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন। কিন্তু দুটি দলের উদ্দেশ্যের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ এবং হাংরির উৎপত্তি ও উদ্দেশ্যের বিরোধী ছিল কৃত্তিবাস। উল্লেখ্য, সমীর রায়চৌধুরী, অর্থাৎ মলয়ের দাদা, শুরুতে এই কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে সম্পূর্ণভাবে এই গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত হয়েই তিনি হাংরি আন্দোলনে যোগ দেন।

১৯৬২-৬৩ সালে হাংরি আন্দোলনে যোগদান করেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, আজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃত তনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। অনিল এবং করুনা ছিলেন চিত্রকর।

হাংরি আন্দোলনকারীরা প্রধানত এক পৃষ্ঠার বুলেটিন প্রকাশ করতেন। যেগুলো পাটনা থেকে প্রকাশিত, সেগুলো ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল। কখনও বা পোস্টকার্ড, পোস্টার এবং এক ফর্মার পুস্তিকা প্রকাশ করতেন। এক পাতার বুলেটিনে তঁরা কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, অশ্লীলতা, জীবন, ছোটগল্প, নাটক, উদ্দেশ্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে ইশতেহার লেখা ছাড়াও, কবিতা, গদ্য, অনুগল্প, স্কেচ ইত্যাদি প্রকাশ করেছিলেন। বুলেটিনগুলো হ্যান্ডবিলের মতন কলকাতার কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস, পত্রিকা দপ্তর, কলেজগুলোর বাংলা বিভাগ ও লাইব্রেরি ইত্যাদিতে তাঁরা বিতরণ করার ফলে খুব অল্প সময়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে হাংরি মুভমেন্ট।

অবশ্য কিছু প্রথাবিরোধী কর্মকাণ্ড যেমন পেইন্টিং প্রদর্শনী করে শেষ দিন প্রতিটি ছবিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া, একটি গ্রন্হের দাম কয়েক লক্ষ টাকা রাখা, বাণিজ্যিক পত্রিকায় গ্রন্হ রিভিউ করার জন্য জুতোর বাক্স পাঠানো কিংবা ছোটগল্পের নামে সাদা কাগজ পাঠানো ইত্যাদি অদ্ভুত কার্যকলাপ ঘটাতে থাকেন তাঁরা। তবে সবচেয়ে বড় ঘটনাটা ঘটে ১৯৬৩ সালে। রাজনীতিবিদগণ, আমলা-সচিব এবং সংবাদপত্রের মালিকদের এক অদ্ভুত বার্তা পাঠান তারা। রাক্ষস, জোকার, মিকিমাউস, দানব, দেবতা, জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদি মুখোশে “”দয়া করে মুখোশ খুলে ফেলুন”” এই কথাটি লিখে পাঠিয়ে দেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, এমএলএ, সচিব ও সাংবাদিক নেতাদের কাছে।

এসব কর্মকান্ডের ফলে স্বাভাবিকভাবেই তেঁতে উঠে প্রশাসন। ১৯৬৪ সালে সেপ্টেম্বরে ইন্ডিয়া পেনাল কোডের ১২০বি , ২৯২ ও ২৯৪ ধারায় মামলা করা হয় মলয়সহ আরও ১০ জনের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হলেন মলয়, সমীর রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ এবং শৈলেশ্বর ঘোষ । এই অভিযোগে উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইশ্যু হয়ে থাকলেও, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। ১২০বি ধারাটা যেহেতু ষড়যন্ত্রের ধারা ছিল, তাই কলকাতা গোয়েন্দা বিভাগ প্রত্যেকের উপর আলাদা করে ডোসিয়ার খুলে তদন্ত করেছিলেন। কিন্তু শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ, হাংরির অন্যতম দুজন সক্রিয় সদস্য যখন হাংরি আন্দোলনের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে মুচলেকা দিলেন এবং মলয়ের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে দাঁড়ালেন, তখন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে নিয়ে ১৯৬৫ সালের মে মাসে বাদবাকি সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কেবল মলয়ের বিরুদ্ধে মামলা হল, সাম্প্রতিকতম হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত তাঁর প্রচণ্ড বৈদ্যূতিক ছুতার কবিতাটি অশ্লীল বলে। প্রসিকিউশনের পক্ষে এই দুজন রাজসাক্ষীকে, নির্ভরযোগ্য মনে হয়নি । তাই মলয়ের বিরুদ্ধে পুলিশের ইনফর্মার দুই ভুয়ো সাক্ষী, সমীর বসু এবং পবিত্র বল্লভকে, উইটনেস বক্সে তোলা হয় , যাদের উদ্দেশ্য ছিল মলয়কে অপরাধী প্রমাণ করা । এরা পুলিশের ইনফর্মার ছিল বলে এদের আইন-কানুন সব জানা ছিল। কিন্তু কৌঁসুলিদের জেরায় এরা ভুয়ো প্রমাণ হবার উপক্রম দেখা দিলে পুলিশ গ্রেপ্তার করে গুম করে ফেলবার ভয় দেখিয়ে উইটনেস বক্সে হাজির করে হাংরি আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় সদস্য শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দিপন চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসুকে। তাঁরা মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। ঠিক সে সময়ে কৃত্তিবাসের সক্রিয় সদস্য শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রত্যক্ষ আবির্ভাব ঘটে এ ব্যাপারে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শুরু থেকেই ছিলেন হাংরির বিপক্ষে। মলয়কে লেখা তাঁর এক চিঠির একাংশে তিনি বলেন “……চালিয়ে যাও ও সব আন্দোলন কিংবা জেনারেশনের ভণ্ডামি। আমার ওসব পড়তে কিংবা দেখতে মজাই লাগে। দূর থেকে। সাহিত্যের ওপর মৌরসি পাট্টা বসাতে এক-এক দলের অত লোভ কী করে আসে, কী জানি। তবে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো। আমাকে দেখেছ নিশ্চয় শান্তশিষ্ট, ভালো মানুষ। আমি তাই-ই, যদিও গায়ে পদ্মাপাড়ের রক্ত আছে। সুতরাং তোমাদের উচিত আমাকে দূরে-দূরে রাখা, বেশি খোঁচাখুঁচি না করা। নইলে, হঠাৎ উত্তেজিত হলে কী করব বলা যায় না। জীবনে ওরকম উত্তেজিত হয়েছি পৌনে একবার। গতবছর। দুএকজন বন্ধুবান্ধব ও-দলে আছে বলে নিতান্ত স্নেহবশতই তোমাদের হাংরি জেনারেশন গোড়ার দিকে ভেঙে দিইনি। এখনও সে ক্ষমতা রাখি, জেনে রেখো। তবে এখনও ইচ্ছে নেই ও খেলাঘর ভাঙার।……”

কিন্তু তারপরও তিনি কোর্টে মলয়ের পক্ষে সাক্ষ্য দেন। মলয়ের দাদা সমীর রায় চৌধুরীকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেন, “……আমার স্ট্যান্ড আমি অনেক আগেই পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছি। আমি হাংরি জেনারেশন পছন্দ করি না ( সাহিত্য আন্দোলন হিসেবে ), আমি ওদের কিছু-কিছু পাজী ব্যবহারে বিরক্ত হয়েছি। মলয়ের দ্বারা কোনোদিন কবিতা লেখা হবে না — আমার রুচি অনুযায়ী এই ধারণা। অপরপক্ষে, লেখার জন্য কোনো লেখককেই পুলিশের ধরার এক্তিয়ার নেই — একথা আমি বহুবার মুখে এবং কৃত্তিবাসে লিখে জানিয়েছি। পুলিশের বিরুদ্ধে এবং যেকোনো লেখকের স্বপক্ষে ( সে লেখকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক যাই হোক না কেন) দাঁড়ানো আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক কাজ বলেই মনে করি। ……যাই হোক, আদালতের সাক্ষ্যতে আমি দুটি কথা বলেছি। মলয়ের লেখার মধ্যে অশ্লীলতা কিছুই নেই— এবং ও লেখাটা ( প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ) আমার ভালোই লেগেছে।……”

১৯৬৫ সালের ২৮শে ডিসেম্বর মামলার রায় হলে রায় যায় মলয়ের বিপক্ষে। দুশো টাকা জরিমানা ( যা ছিল ওই ধারায় সেসময়ে সর্বোচ্চ ) অনাদায়ে আট মাসের কারাদণ্ড ধার্য করলেন ফৌজদারি আদালতের বিচারক। ১৯৬৭ সালের ছাব্বিশে জুলাই রিভিশন পিটিশানের শুনানি হলে নিম্ন আদালতের রায় নাকচ করে দিয়ে মলয়কে বেকসুর খালাস প্রদান করলেন বিচারপতি টি.পি. মুখার্জি।

হাংরি ফুরিয়ে গেলেও তার আবির্ভাবের প্রভাব বেশ ভালোই প্রতিফলিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। হাংরি আন্দোলনের পূর্বে পত্রিকার নাম হতো কবিতা, পূর্বাশা, অরণি, কৃত্তিবাস, অগ্রণি, শতভিষা, ধ্রুপদী, ক্রান্তি ইত্যাদি। হাংরি আন্দোলনকারীরা কৌরব, আবার এসেছি ফিরে, মানুষের বাচ্চা, ঢ়পের কাগজ, ক্ষেপচুরিয়াস, দিল্লী হটার্স ইত্যাদি নাম রাখার চল শুরু করে। গুরুচন্ডালী শব্দ গঠন ও বাক্য প্রয়োগ যা হাংরি আন্দোলনের পূর্বে নিষিদ্ধ ছিল, তা এখন সাধারণ উপকরণ হিসেবেই ব্যবহৃত হয় গল্প-কবিতায়।

১৯৭০ সালের শেষদিকে উত্তরবঙ্গ ও ত্রিপুরার কবিরা আবারও আন্দোলনকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সঠিক তাত্ত্বিক ভিত্তি জানা না থাকায় তাঁরা বেশিদুর এগোতে পারেননি। এ ব্যাপারে মলয় রায়চৌধুরী বলেন, “হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে গিয়েছে সেই ষাটের দশকে। এখন শুরু হয়েছে তাকে নিয়ে ব্যবসা। সমীর চৌধুরী নামে আনন্দবাজার পত্রিকার এক কর্মী ( আমার দাদার নামের সঙ্গে মিলটা কাজে লাগিয়ে¬) ‘হাংরি জেনারেশন রচনা সংকলন’ নামে একটা বই বের করেছেন। তাতে অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ লেখককে আমি চিনি না। এই সংকলনে আমার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু, সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, আলো মিত্র, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের রচনা নেই! সুবিমল বসাক, অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায়-এর আঁকা ড্রইং নেই। একটাও ম্যানিফেস্টো নেই। বাজার নামক ব্যাপারটি একটি ভয়ঙ্কর সাংস্কৃতিক সন্দর্ভ।”

হাংরি আন্দোলনের মতো কোন সাহিত্য আন্দোলনের প্রয়োজন বাংলা সাহিত্যে ছিল কি ছিল না, তা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু এই অদ্ভুত প্রচেষ্টা একটা তোলপাড় যে তুলতে পেরেছিল, তা সন্দেহাতীত।

তথ্যসূত্রঃ

১/ প্রতিসন্দর্ভের স্মৃতিঃ মলয় রায়চৌধুরী

২/ হাংরি আন্দোলন সংক্রান্ত চিঠিপত্র (Hungry Generation)

৩/ হাংরি আন্দোলন– এক অভূতপূর্ব দ্রোহের বিস্ফোরণ…: ডন মাইকেল কর্লিওনি

৪/ হাংরি আন্দোলন – উইকিপিডিয়া

“কল্পনা” শব্দটি দ্বারা কি বোঝায়? মানুষের চিন্তা, ধারণা, উদ্ভাবন, দর্শন, অনুমান, সাপেক্ষতা…… আরও নানা সমার্থক শব্দ বের করা যায় এর।

Wikipediaতে দেয়া তথ্যানুসারে, “Imagination, also called the faculty of imagining, is the ability to form new images and sensations that are not perceived through sight, hearing, or other senses.” অর্থাৎ কল্পনা হলো “যা সরাসরি ইন্দ্রিয় অনুভূতিতে নাই তাকেও জ্বলজ্যান্ত করে তোলার ক্ষমতা।”- ডঃ মুহাম্মদ ইব্রাহীম।

কিন্তু এই অপরিসীম ক্ষমতার ধারকটি কি? উত্তর একটাই, মস্তিষ্ক। আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের সব চিন্তা-চেতনার আধার। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক বাম ও ডান এই দুটি অর্ধগোলকে ভাগ করা থাকে।

cerebral_cortex_lobesআর প্রত্যেক অর্ধগোলকের মধ্যে একটু আলাদা করে স্পষ্ট চারটি পিন্ড(Lobe) আকৃতির অংশকে চিহ্নিত করা যায়- ফ্রন্টাল, অক্ষিপেটাল, টেম্পোরাল ও পেরিয়েটাল। চিন্তা-চেতনার উচ্চতর কাজগুলোর দিক থেকে মস্তিষ্কের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে এই চারটি পিন্ড জুড়ে কোঁকড়ানো উপরিভাগ যাকে বলা হয় কোর্টেক্স। এই কোর্টেক্সই হচ্ছে মস্তিষ্কের হেডকোয়ার্টার। এর ফ্রন্টাল অংশটিতে শরীরের নানা অঙ্গের নড়াচড়ার নিয়ন্ত্রণ থাকে যাকে বলা হয় মোটর মেকানিজমের নিয়ন্ত্রণ। এছাড়া আবেগের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ, উচ্চতর সৃজনশীল কাজের সূক্ষ বিবেচনা…এগুলোও ফ্রন্টাল অংশের কাজ।

কিন্তু আমাদের এই কল্পনাশক্তি মূলত স্মৃতিনির্ভর। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল সেমেনটিক মেমোরি অর্থাৎ বিশ্ব সম্পর্কে নিজের ধারণাকৃত স্মৃতি বা ধারণা। চারপাশের দুনিয়াটা কি ও কেমন, এর মধ্যে একজন মানুষ হিসেবে নিজের অবস্থানটা কোথায়- এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সন্নিহিত থাকে সেমেনটিক মেমোরির ভেতর। আর স্মৃতির সাথে আরেকটি বিষয় ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে থাকে; বুদ্ধিমত্তা। এক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার প্রক্রিয়াটি কিভাবে ঘটে তার একটি সম্ভাব্য তত্ত্ব দেখানো যায়। ডঃ মুহাম্মদ ইব্রাহীমের ভাষ্যানুসারে, “……এতে অনুধাবনে আসা এক একটি বিষয়ের প্রতিনিধিত্বকারী কোড স্নায়ু প্যাটার্নের আকারে মস্তিষ্কে সৃষ্টি হয়। তাদের আশেপাশের জায়গাগুলোতে কিছু কিছু জায়গা ছেড়ে তার অনেকগুলো প্রতিলিপি বা ক্লোন মস্তিষ্কে সৃষ্টি হয়। এভাবে বেশ কিছু ক্লোন তৈরী হতে যথেষ্ট সময় লাগে। এসব ক্লোনে নানা বৈচিত্র হতে পারা এবং তাদের মধ্যে একটি সার্থক কোডিং প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই বুদ্ধির বিকাশ ঘটে। তাই অনেক ক্লোন কলোনি গড়ে উঠার জন্য যত বেশি কার্যকর জায়গা মস্তিষ্কে পাওয়া যাবে, বুদ্ধির চর্চায় ততই সুবিধা। এ কাজের জন্য কোর্টেক্সে উন্মুক্ত জায়গা প্রয়োজন।………..মানুষের মস্তিষ্কের কোর্টেক্স অন্য প্রাইমেটের তুলনায় অনেক বড়। দর্শন, শ্রবণ ইত্যাদির জন্য রিজার্ভ করা জায়গাগুলোর বাইরে কোডিং ক্লোন কলোনির জন্য উন্মুক্ত জায়গা সেখানে অনেক বেশি রয়েছে। এটি এত বেশি যে দৈনন্দিন তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মিটিয়ে আমরা মস্তিষ্কের এই জায়গার কিছু বিলাসী ব্যবহারও করতে পারি। যেমন একটি উদাহারণ নেয়া যাক। আমরা ঘোড়াকে চিনি এবং ঘোড়াকে অনুধাবনের স্মৃতি আমাদের মস্তিষ্কে আছে। একই ভাবে বড় নানা পাখির স্মৃতিও আমাদের মস্তিষ্কে আছে। নূতন কোন অনুধাবনে যখন আমাদের মস্তিষ্কে কোডের ক্লোন কলোনি সৃষ্টি হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রাসঙ্গিক স্মৃতির সঙ্গে তা অনুরণিত হতে পারে। আমাদের ক্ষেত্রে কখনো কখনো ঘোড়া আর পাখির উভয়টির স্মৃতির সঙ্গে অনুরণিত হতে গিয়ে উভয়ের নানা উপাদান মিশিয়ে মস্তিষ্কে ‘পঙ্খীরাজ ঘোড়া’র কোড সৃষ্টি হতে পারে। তখন স্মৃতির সিনাপ্স প্যাটার্নে উভয়টি থেকে এখানে এর এক টুকরো ওর এক টুকরো মিশিয়ে এমন ক্লোন কলোনি সৃষ্টি হতে পারে যা সত্যিকার অনুধাবনেই ছিল না। এসব করার জন্য বেশি জায়গা আমাদের মস্তিষ্কে রয়েছে বলেই আমাদের পক্ষে এটি সম্ভব। এভাবে তৈরী মিশ্র কলোনিও যথারীতি কোডিং প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে পারে এমনকি কলোনিগুলোর ঐকতানে প্রাধান্যও বিস্তার করতে পারে। এর একটি ফলশ্রুতি হলো ঘোড়ার দেহ আর পাখির ডানা দিয়ে উড়ন্ত পঙ্খীরাজ আমাদের বুদ্ধিজাত চিন্তায় বেশ স্থান পেয়ে যেতে পারে-চাই কি নাক দিয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হওয়া সহ। …… এটি একবার করে ফেললে মানুষ যথারীতি একে তার স্বাভাবিক চিন্তা প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসতে পারে, এ নিয়ে গল্প তৈরী করে আবেগের প্রকাশ ঘটাতে পারে, এমনকি বিমান ডিজাইনার হিসাবে প্রয়োজন হলে পঙ্খীরাজের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বাস্তব ক্ষেত্রেও নূতন উদ্ভাবন করতে পারে। কল্পনা শক্তি মানুষের চিন্তাকে এই গুরুত্বপূর্ণ অনন্যতাটি দিয়ে থাকে। আর তা সম্ভব হয়েছে মূলত তার বৃহত্তর মস্তিষ্কের জন্য।”

এক কথায়, এই কল্পনাশক্তি আমাদের বাস্তব জগতের নিত্যনতুন উদ্ভাবনের প্রধান হাতিয়ার। তবে এই কল্পনা মূলত একটি বিশেষ মুহুর্তের মনের সাধারণ প্রবণতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই বাস্তব জীবনে এর মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব পড়লে ক্ষেত্রবিশেষে হিতে বিপরীত ঘটে। বিভিন্ন ধরণের মানসিক সমস্যা, কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাসের জন্ম ঘটে এই কল্পনার প্রভাবেই।

তবুও এই সীমাহীন ক্ষমতার জোরেই মানবজাতি অন্যান্য প্রাণী থেকে নিজেকে করেছে পৃথক। সাধে কি আর মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, “Imagination … is more important than knowledge. Knowledge is limited. Imagination encircles the world.”

সূত্রঃ
১। Wikipedia: http://en.wikipedia.org/wiki/Imagination

২। আমরা কীভাবে চিন্তা করি- ডঃ মুহাম্মদ ইব্রাহীম

৩। অন্য জন্ম- তানজিনা হোসেন।